বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার অপারেটর পদে কর্মরত আছেন সুমন হোসেন (৩২)। তার স্ত্রীর দুটি কিডনি দুই বছর ধরে বিকল। সপ্তাহে দুই দিন সরকারি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস করাতে খরচ হয় ১ হাজার ১২০ টাকা। মাসে শুধু স্ত্রীর কিডনি ডায়ালাইসিসে সুমনের খরচ ৬ হাজার ৭২০ টাকা। এর সঙ্গে ওষুধ, চিকিৎসক, যাতায়াত মিলিয়ে মাসে ১০ হাজার টাকার বেশি খরচ হয়ে যায় চিকিৎসার পেছনে। ট্রান্সপ্লান্টে আগ্রহ থাকলেও মিলছে না কিডনি। কিডনি রোগে আক্রান্ত স্ত্রীকে বাঁচিয়ে রাখতে জীবনযুদ্ধে নেমেছেন সুমন। দেশে প্রতিনিয়ত বাড়ছে কিডনি রোগী। প্রায় ২ কোটি মানুষ কিডনি রোগে ভুগছেন। ভেজাল খাবার ও ওষুধ সেবন কিডনি রোগী বাড়াচ্ছে।
অতিরিক্ত ওষুধ সেবনেও বাড়ছে এই রোগ। ডায়াবেটিস ও হাইপারটেনশনে থাকা মানুষের কিডনি রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। কিডনি রোগের চিকিৎসা বেশ ব্যয়বহুল হওয়ায় খরচ বহন করতে হিমশিম খায় রোগীর স্বজনরা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপ-উপাচার্য এবং বাংলাদেশ রেনাল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. মুহাম্মদ রফিকুল আলম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘গত ১০-১৫ বছরে দেশে কিডনি রোগ ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। কিডনি রোগকে নীরব ঘাতক বলা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কিডনি নষ্ট হওয়ার পর দেখা যায় উপসর্গ। ন্যাফ্রাইটিস থেকে কিডনি রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ব্যাপকহারে বাড়ছে।
এটি সাধারণত খাদ্যে ভেজাল, ওষুধের যত্রতত্র ব্যবহার, ভেজাল ওষুধ সেবনের কারণে হয়। বিদেশে চাইলেই ফার্মেসি থেকে ওষুধ কেনা যায় না। সেখানে চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন প্রয়োজন হয়। অথচ আমাদের দেশে যে কেউ ফার্মেসিতে গিয়ে অ্যান্টিবায়োটিক কিনতে পারে। ক্ষতিকর ব্যথানাশক ওষুধ পাওয়া যায় অহরহ। এসব ওষুধ কিডনির ব্যাপক ক্ষতি করে।’
বিএসএমএমইউর নেফ্রোলজি বিভাগের এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আরও বলেন, ‘এশিয়া ও আফ্রিকার কিছু দেশে এক ধরনের কিডনি রোগ পাওয়া যাচ্ছে। এটিকে বিজ্ঞানীরা বলছেন, ক্রনিক কিডনি ডিজিজ অব আননোন কজ, অর্থাৎ যার কোনো কারণ নেই। কারণ ছাড়াই কিডনি রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
এসব রোগীদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, শস্যে-সবজিতে কীটনাশকের ব্যবহার বা প্রিজারভেটিভ সহনীয় মাত্রার তুলনায় অনেক বেশি পরিমাণে থাকে। সেগুলোর ক্ষেত্রে সাধারণত হেভি মেটাল অ্যালমিয়া, অ্যাডমিয়া বা আর্সেনিকের মতো হেভি মেটাল থাকে। অনেক দিন ধরে এসব খাওয়ার ফলে দেখা যায়, তাদের ক্রনিক কিডনি ডিজিজ হচ্ছে।
এ ধরনের সমস্যা শ্রীলঙ্কায় সবচেয়ে বেশি পাওয়া যাচ্ছে। বাংলাদেশ এবং ভারতেও পাওয়া যাচ্ছে এ ধরনের রোগী।’ গত ২২ মার্চ ভুয়া ওষুধ তৈরি এবং কুরিয়ার করে বাজারে ছড়িয়ে দেওয়ায় দুজনকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী। দেশি নামি কোম্পানির পরিচিত দামি ওষুধ ঘরে বসে বানিয়ে বিক্রি করে আসছিল প্রতারক চক্র। সরকারি বড় হাসপাতালের আশপাশের ফার্মেসিগুলোর যোগসাজশে এসব ভুয়া ওষুধের রমরমা ব্যবসা চলে। এসব ভেজাল ওষুধ নষ্ট করে দিচ্ছে কিডনির কার্যক্ষমতা।
ভেজাল পণ্যে সয়লাব বাজার। বাহারি শরবত, রকমারি খাবারে ‘ফুড গ্রেড’র নামে ব্যবহার করা হচ্ছে কারখানায় ব্যবহৃত রং। দীর্ঘদিনের পোড়া তেলে ভাজা হচ্ছে বেগুনি, পিঁয়াজু, চপ। মরিচের গুঁড়ায় ব্যবহার হচ্ছে গুঁড়ো ইট। ফলে বাড়ছে কিডনি রোগের ঝুঁকি।
বিশ্ব সাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, প্রতি বছর বিশ্বের প্রায় ৬০ কোটি মানুষ ভেজাল ও দূষিত খাদ্য গ্রহণের কারণে অসুস্থ হয়। এর মধ্যে মারা যায় ৪ লাখ ৪২ হাজার মানুষ। এ ছাড়া দূষিত খাদ্য গ্রহণজনিত কারণে পাঁচ বছরের কম বয়সের আক্রান্ত হওয়া ৪৩ শতাংশ শিশুর মধ্যে মৃত্যুবরণ করে ১ লাখ ২৫ হাজার। পরিবেশ বাঁচাও অন্দোলনের (পবা) এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধু ভেজাল খাদ্য গ্রহণের কারণে প্রতি বছর দেশে দুই লাখ লোক কিডনি রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
সেন্টার ফর কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি (সিকেডি) হাসপাতালের অধ্যাপক স্বাধীনতা পুরস্কার প্রাপ্ত চিকিৎসক মো. কামরুল ইসলাম বলেন, ‘বাইরে থেকে কেনা খাবারে বিভিন্ন অস্বাস্থ্যকর উপাদান মেশানো হয়। শরীরের জন্য ক্ষতিকর রং, প্রিজারভেটিভ, ফরমালিন ব্যবহার করা হয়। মুখরোচক করার জন্য অতিরিক্ত তেল ব্যবহার করা হয়।
এসব উপাদান মানুষকে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ফেলে। কিডনি রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয় এসব খাবার। অনেক উপাদান দীর্ঘমেয়াদি ক্ষত তৈরি করে এবং দুরারোগ্য রোগ জন্ম দেয়। তাই এসব খাবার থেকে দূরে থাকতে হবে। বাড়িতে স্বাস্থ্যকর উপায়ে বানানো খাবার খাওয়ার অভ্যাস গড়তে হবে। ব্যবসায়ীদেরও খাবারে ভেজাল দেওয়া থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানান তিনি।’ কিডনি অকেজো হওয়ার পর ডায়ালাইসিস করে বেঁচে থাকতে কিডনি রোগীদের ১২-২২ শতাংশের সম্পদ বিক্রি করে দিতে হচ্ছে। দেশের কিডনি রোগীদের মোট ১ শতাংশেরও কম কিডনি প্রতিস্থাপনের সুবিধা রয়েছে। তবে কিডনি রোগটি প্রাথমিক অবস্থায় নিরূপণ করতে পারলে চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে যেতে পারে।
কিন্তু বাংলাদেশে প্রয়োজনের তুলনায় নেফ্রলজিস্ট নেই। চিকিৎসা ব্যয় বেশি হওয়ায় অনেকেই মধ্যপথে বন্ধ করে দিচ্ছে চিকিৎসা। সচেতনতা, চিকিৎসক ও চিকিৎসার পর্যাপ্ততা এবং মৃত ব্যক্তির কিডনি সংগ্রহে আইনি বিধিমালা সংশোধনে কিডনি রোগের মরণ কামড় কমিয়ে আনা সম্ভব বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। আইনের সীমাবদ্ধতার কারণে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে কিডনি প্রতিস্থাপন। মানবদেহে অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন ১৯৯৯ অনুযায়ী, শুধুমাত্র রক্তের নিকটাত্মীয় ছাড়া অন্য কেউ কিডনি দিতে পারে না।
বিএসএমএমইউর নেফ্রোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘ভেজাল খাবার, ওষুধের ক্ষতিকর প্রভাব মানুষের কিডনিতে পড়ে। অনেকে ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ব্যথানাশক ওষুধ খান। এ ছাড়া যারা বেশি দিন হারবালের নাম করে শিকড়, বাকড় খান তাদেরও কিডনিতে প্রভাব পড়ে। জাঙ্কফুডের ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে কিডনির ওপরে। এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আরও বলেন, ‘কিডনি রোগ সাধারণত দুই ধরনের হয় অ্যাকুয়িট এবং ধীরগতির। ধীরগতির হলে ডায়ালাইসিস এবং ট্রান্সপ্লান্টের ব্যবস্থা করা হয়।
সপ্তাহে কমপক্ষে দুই বার ডায়ালাইসিস করতে হয়। এতে একটা নিয়মিত বড় ধরনের খরচ করতে হয় রোগীর স্বজনদের। সে তুলনায় ট্রান্সপ্লান্টে খরচ কম। কিডনি দাতার সঙ্গে গ্রহীতার সম্পর্কে আইনি জটিলতা না থাকলে আমাদের হাসপাতালে ২ লাখ টাকার মতো খরচে ট্রান্সপ্লান্ট করা যায়। ট্রান্সপ্লান্টের জন্য কিডনি সংগ্রহ বাড়াতে মৃত ব্যক্তির কিডনি সংগ্রহে খসড়া চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। খুব দ্রুতই এটি আলোর মুখ দেখবে।’