আত্মহত্যা একটি প্রধান বৈশ্বিক সমস্যা। বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর প্রায় ৮ লাখ মানুষ আত্মহত্যা করে মারা যায়। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, আত্মহত্যার প্রায় এক তৃতীয়াংশ ঘটে তরুণদের মধ্যে।
১৫-২৯ বছর বয়সীদের মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ হলো আত্মহত্যা। বিশ্বব্যাপী আত্মহত্যার হার প্রতি ১ লাখ ব্যক্তির মধ্যে ১২জন। আত্মহত্যা বর্তমানে বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর ১৪ তম প্রধান কারণ।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৬ সালে বাংলাদেশে আত্মহত্যা করেছেন ১০ হাজার ৭৪৯ জন। ২০১৭ ও ২০১৮ সালে দেশে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে যথাক্রমে ১০ হাজার ২৫৬ ও ১১ হাজার। ২০১৯-২০ সময়কালে দেশে আত্মহত্যা করেছেন ১৪ হাজার ৪৩৬ জন, যাদের মধ্যে ২০-৩৫ বছর বয়সীই সবচেয়ে বেশি।
কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার প্রবণতাও উদ্বেগজনক। ২০২১ সালে এই পথ বেছে নিয়েছেন ১০১ জন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী।
যেহেতু আত্মহত্যা সংবেদনশীল বিষয়, যা পারিবারিক দুর্নাম, কলঙ্ক, অপরাধীকরণ ও দুর্বল নজরদারি ব্যবস্থার কারণে খুব কম রিপোর্ট করা হয়। এ কারণে আত্মহত্যার আরও অনেক ঘটনা চাপা পড়ে যায়।
আত্মহননের কারণ কি মানসিক ব্যাধি?
বিশেষজ্ঞদের মতে, আত্মহত্যা কোনো মানসিক অসুস্থতা নয়। তবে বিষণ্নতা, বাইপোলার ডিসঅর্ডার, পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার, বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার, সিজোফ্রেনিয়া, পদার্থ ব্যবহারের ব্যাধি, উদ্বেগজনিত ব্যাধি, বুলিমিয়া বা অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসার মতো মানসিক ব্যাধির কারণ আত্মহত্যাকে প্ররোচিত করতে পারে।
ঝুঁকির কারণ ও সতর্কতা সংকেত
সামাজিক, মনস্তাত্ত্বিক, সাংস্কৃতিক ও অন্যান্য অনেক কারণ আত্মহত্যামূলক আচরণের ঝুঁকি বাড়ায়। আত্মহত্যার ঝুঁকির কারণগুলোর মধ্যে আছে অতীতে আত্মহত্যার প্রচেষ্টা, মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা, অ্যালকোহলের ক্ষতিকর ব্যবহার, মাদকের ব্যবহার, চাকরি বা আর্থিক ক্ষতি, সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া, আঘাত বা অপব্যবহার, সহিংসতা, সংঘর্ষ বা দুর্যোগ কিংবা দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা বা অসুস্থতা।
আত্মহত্যার সতর্কীকরণ চিহ্ন
এর মধ্যে যে কোনো একটি হতে পারে আত্মহত্যার সম্ভাব্য সতর্কতা লক্ষণ।
> দীর্ঘস্থায়ী দুঃখ, মেজাজ পরিবর্তন ও অপ্রত্যাশিত রাগ।
>> ভবিষ্যত সম্পর্কে গভীর হতাশার অনুভূতি অনুভব করা।
>> ঘুমের সমস্যা।
>> হতাশা বা মানসিক অবস্থার পর হঠাৎ শান্ত হয়ে যাওয়া।
>> বন্ধুবান্ধব বা সামাজিক ক্রিয়াকলাপ এড়িয়ে যাওয়া।
>> একা থাকতে পছন্দ করা।
>> ব্যক্তিত্ব বা চেহারায় পরিবর্তন।
>> বিপজ্জনক আচরণ, যেমন- বেপরোয়া ড্রাইভিং, অনিরাপদ যৌনতায় লিপ্ত হওয়া, মাদক বা অ্যালকোহলের বর্ধিত ব্যবহার।
>> জীবনের একটি বড় সংকটাপন্ন অবস্থা আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ায়।
>> আত্মহত্যার বিষয়ে চিন্তা করা ৫০-৭৫ শতাংশ মানুষ সতর্কতা চিহ্ন হিসেবে আত্মহননের হুমকি দেয়। আত্মহত্যার প্রতিটি হুমকিকে গুরুত্ব সহকারে নেওয়া উচিত।
আত্মহত্যার প্রতিরোধে করণীয়
বিশ্বব্যাপী জনস্বাস্থ্য ও পাবলিক পলিসি এজেন্ডাগুলোতে আত্মহত্যা প্রতিরোধকে অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন। এমনকি জনস্বাস্থ্যের উদ্বেগ হিসেবে আত্মহত্যা সম্পর্কে সচেতনতা একটি বহুমাত্রিক পদ্ধতির ব্যবহার করা জরুরি। যা সামাজিক মনস্তাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাবকে স্বীকৃতি দেয়।
আত্মহত্যার চেষ্টা করা রোগীদের জন্য প্রথম অগ্রাধিকার হলো হাসপাতালে চিকিৎসা স্থিতিশীল করা। যে সব রোগীরা মাদক গ্রহণের চেষ্টা করেন তাদের দূষণমুক্ত করা উচিত ও প্রতিষেধক গ্রহণ করা উচিত।
আত্মহত্যা প্রতিরোধে করণীয় বিষয়ে অধ্যাপক ড. মাহফুজা খানম বলেন, আত্মহত্যা প্রতিরোধে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন সঠিক কাউন্সেলিং। কিশোর- কিশোরীদের মানসিকভাবে সুস্থ রাখতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখেন তাদের মা-বাবা। তাদের উচিত সন্তানদের সঙ্গে বন্ধুত্বসুলভ সম্পর্ক গড়ে তোলা।
সন্তানদের সঙ্গে এমন সম্পর্ক রাখা যাবে না যাতে তারা নিজের মনের কথা না বলে উল্টো ভয় পায়। তাদের কথা শুনতে হবে। সমস্যা হলে বোঝাতে হবে, পরামর্শ কিংবা সমাধান দিতে হবে।